বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য
বাংলা গোয়েন্দাকাহিনীর সূত্রপাত
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে। এর আগে অবশ্য বটতলার কিছু কিছু বইয়ে অপরাধকাহিনী
স্থান পেয়েছিল। কিন্তু সেখনে গোয়েন্দা বা রহস্যভেদের ব্যাপারটা ঠিক
ছিল না । বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের সূচনা সম্পর্কিত আলোচনায় যে বইটির
কথা অনেক লেখকই উল্লেখ করেছেন - সেটি হল প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের
'দারোগার দপ্তর'। 'দারোগার দপ্তর' প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে একশো
বছরেরও বেশী আগে, ১৮৯২ সালে। প্রিয়নাথবাবু নিজে ছিলেন পুলিশের ডিটেকটিভ
বিভাগের কর্মচারী, সুতরাং ক্রাইম ও ডিটেকশনের ব্যাপারে ওঁর প্রত্যক্ষঅভিজ্ঞতা
ছিল। তারই ভিত্তিতে পুলিশী বিবরণমূলক নানান কাহিনী উনি লিখেছিলেন।
কিন্তু ওঁর লেখায় সাহিত্যগুণ ছিল অনুপস্থিত।
বাংলা সাহিত্যে প্রথম মৌলিক
ডিটেকটিভ কাহিনীর লেখক সম্ভবতঃ পাঁচকড়ি দে। ওঁর লেখাগুলি বেশির ভাগই
ছিল উপন্যাস - ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হত। কিছু ডিটেকটিভ গল্পও
উনি লিখেছিলেন। পেশাদার ডিটেকটিভ বস্তুটির সঙ্গে সে সময়কার বাংলা
পাঠকদের কোনও পরিচয় ছিল না। সম্ভবতঃ সেইজন্যেই ওঁর ডিটেকটিভরা ছিলেন
হয় কর্মরত, নয় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের কর্মচারী। পাঁচকড়িবাবুর দুই প্রধান
ডিটেকটিভ অরিন্দম বসু ও দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র ছিলেন আবার দাদাশ্বশুর
ও নাতজামাই! পাঁচকড়ি দে তাঁর লেখায় প্রধানতঃ উইল্কি কলিন্স ও এমিল
গাবোরিয়র-এর ধারা অনুসরণ করলেও, পরে কোনান ডয়েলের লেখা থেকে প্রচুর
উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন (যেমন, 'হরতনের নওলা' কোনান ডয়েলের 'সাইন
অফ দ্য ফোর'-এর অনুবাদ)। তবে ওঁর বৈশিষ্ট্য ছিল বিদেশী মালমশলাকে
দেশী ছাঁচে ফেলে পাঠকদের বিতরণ করা। ওঁর অনেক লেখা বিভিন্ন ভারতীয়
ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে বাংলা
গোয়েন্দা-গল্প খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। ১৮৯৪ সাল থেকে ১৮৯৮ সাল
পর্যন্ত ডিটেকটিভ গল্পের সংকলন 'গোয়েন্দা কাহিনী' সাময়িকপত্রের মত
মনিহারী দোকানে ও রাস্তায় ফর্মা হিসেবে বিক্রি হত। ১৮৯৬ সালের একটি
বিজ্ঞাপন অনুসারে 'গোয়েন্দা কাহিনী'-র পাঁচ লক্ষ ফর্মা এর মধ্যেই
নাকি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল! বিভিন্ন লেখক এই গোয়েন্দা কাহিনীতে গল্প
লিখতেন - তাঁদের মধ্যে মণীন্দ্রনাথ বসু (রাজনারায়ণ বসুর পুত্র),
শরচ্চন্দ্র সরকার, প্রমুখ ছিলেন।
কিশোরদের জন্যে গোয়েন্দাগল্পের
প্রথম লেখক হিসেবে অনেকে হরিসাধন মুখোপাধ্যায়কে সম্মান দেন। তাঁর
লেখা আশ্চর্য হত্যাকাণ্ড 'সখা ও সাথী' মাসিক পত্রিকায় ১৮৯৪
সালে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। সে যুগে হরিসাধন মুখোপাধ্যায় ছিলেন
বহু-পঠিত লেখক। তবে সেই সময়ে তরুণ পাঠকদের সবচেয়ে বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ
করেছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। পাঁচকড়ি দে যখন খ্যাতির তুঙ্গে তখন
দীনেন্দ্রকুমার রায়ের আবির্ভাব। ভারতী পত্রিকায় কিছু মৌলিক গল্প
দিয়ে দীনেন্দ্রকুমারের গোযেন্দা-সাহিত্যের শুরু। ১৯০১ সালে ওঁর গোয়েন্দা
গল্পের সংকলন পট প্রকাশিত হয়। কিন্তু দীনেন্দ্রকুমারের
অসামান্য জনপ্রিয়তার মূলে ছিল ওঁর 'রহস্য লহরী' সিরিজ। 'রহস্য লহরী'
সিরিজে তিনি ২১৭টি গোয়েন্দাকাহিনী লিখেছিলেন। দীনেন্দ্রকুমার রায়ও
পাঁচকড়ি দে-র মতো বিদেশী গল্পের প্লট নিয়েছেন এবং অনেক সময়ে প্রায়
আক্ষরিক অনুবাদও করেছেন। কিন্তু পাঁচকড়ি দে-র মতো স্থান-কাল-পাত্র
পাল্টাবার চেষ্টা করেন নি। দীনেন্দ্রকুমারের বিখ্যাত গোয়েন্দা রবার্ট
ব্লেক-এর অনেক গল্পই বিলেতি পাক্ষিকে প্রকাশিত স্যাক্সটন ব্লেক-এর
গল্প থেকে নেওয়া। ওঁর গল্পে গঙ্গা বা চৌরঙ্গীর বদলে থাকতো টেমস নদী,
পিকাডেলি, ইত্যাদি। গল্প পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন জায়গার
সঙ্গে পরিচয় ঘটে যেত পাঠকগোষ্ঠীর।
দীনেন্দ্রকুমারের
পর বাংলা কিশোর গোয়েন্দাসাহিত্য সম্বৃদ্ধ হল মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের
লেখায়। এবার আর ইংরেজ গোয়েন্দা নয়, ১৯২৮ সালে 'রামধনু' পত্রিকায়
পদ্মরাগ গল্পে জাপানী ডিটেকটিভ হুকাকাশি'র আবির্ভাব হল।
পড়ে মুগ্ধ হল নবীন পাঠকরা। তবে বড়রাও বাদ পড়লেন না। কিশোরদের জন্যে
লেখা গোয়েন্দা গল্প বড়রাও সেযুগে আগ্রহভরে পড়তেন ও উপভোগ করতেন।
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের কয়েক বছর বাদেই গোয়েন্দা গল্প লিখতে কলম ধরলেন
সুসাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়। বাংলা গোয়েন্দা গল্পে বিজ্ঞানের
সার্থক প্রয়োগ করে তিনি ছোট বড় সবার মনই জয় করলেন। ১৯৩০ সালে 'মৌচাক'
পত্রিকায় বার হল তাঁর প্রথম গোয়েন্দা গল্প। বিষয়বস্তু বিলিতি, কিন্তু
সেগুলি খাঁটি দেশজ করে তুলতে হেমেন্দ্রকুমারের জুড়ি ছিল না। ওঁর
গোয়েন্দা জয়ন্ত ও তার সহকারী মানিক এবং পুলিশ ইনস্পেক্টর সুন্দরবাবুর
গল্প রুদ্ধশ্বাসে পড়ে নি তেমন কিশোর (বা বয়স্ক) পাঠক সেকালে কমই
ছিলো। হেমেন্দ্রকুমারের অন্য গোয়েন্দাজুটি ছিলো হেমন্ত ও রবিন। সঙ্গে
ছিলেন ইনস্পেক্টর সতীশবাবু।
১৯৩২ সালে মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়
একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করলেন 'রোমাঞ্চ' নাম দিয়ে। প্রথম
সংখ্যায় গল্প লিখলেন প্রণব রায়, যাঁর ডিটেকটিভের নাম প্রতুল লাহিড়ী।
এরপর নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অনেক লেখক এই পত্রিকায়
লিখলেন, কিন্তু ডিটেকটিভের নাম সেই একই থাকলো।
এর পরে যিনি এলেন - তিনি ছোট
বড় দুই ধরণের পাঠকদের জন্যেই গোয়েন্দা গল্প লিখলেন। ১৩৩৯ সালে সত্যান্বেষী
দিয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়যাত্রা সুরু - ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ
বক্সী। শরদিন্দু ব্যোমকেশের বহু কাহিনী লিখিয়েছেন ব্যোমকেশের বন্ধু
অজিতকে দিয়ে (শার্লক হোমস-এর ডক্টর
ওয়াটসন
বা হারকিউল পয়রো-র ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর মতো)। কিন্তু শেষের অনেকগুলি
গল্পে লেখক নিজেই কথকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের
প্রসাদগুণে ব্যোমকেশের কাহিনীগুলি শুধু গোয়েন্দাগল্প নয়, সেটি হয়ে
উঠেছে সাহিত্য। সুকুমার সেন লিখেছেন, " কাহিনীকে ভাসিয়ে তাঁর
ভাষা যেন তর তর করে বয়ে গেছে সমাপ্তির সাগরসঙ্গমে। সে ভাষা সাধু
না চলিত বলা মুস্কিল। ---- শরদিন্দুবাবুর স্টাইল তাঁর নিজেরই - স্বচ্ছ,
পরিমিত, অনায়াসসুন্দর। "
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত
বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে বড়দের জন্যে কিছু গল্প-উপন্যাস থাকলেও কিশোরদের
জন্যে লেখার প্রাধান্যই সেখানে বেশী চোখে পড়ে। বড়দের গোয়েন্দাকাহিনীর
লেখক হিসেবে নীহাররঞ্জন গুপ্তের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। তাঁর
গোয়েন্দা ছিলেন কিরীটি। তবে নীহাররঞ্জন কিশোরদের জন্যেও লিখেছিলেন।
গজেন্দ্রকুমার মিত্রও ক্রাইম ও গোয়েন্দা কাহিনী দিয়ে লেখা শুরু করেছিলেন।
পরে অবশ্য ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিশোরদের
ক্রাইম থ্রিলার 'মোহন সিরিজ' লিখে শশধর দত্তের জনপ্রিয়তাও বিংশ শতাব্দীর
মধ্যভাগে তুঙ্গে ওঠে। এছাড়া চার দশকের মাঝামাঝি দেব সাহিত্য কুটিরের
কাঞ্চনজঙ্ঘা, প্রহেলিকা, বিশ্বচক্র, পিরামিড ও কৃষ্ণা সিরিজ-এর দৌলতে
নানা গল্প-উপন্যাসে কিশোর গোয়েন্দাসাহিত্য সম্বৃদ্ধ হয়েছে। এতে লেখক
হিসেবে হেমেন্দ্রকুমার রায় ও নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়কে ছাড়াও
আমরা পাই বুদ্ধদেব বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
ও শৈলবালা ঘোষজায়াকে। বড়দের গোয়েন্দা-বিষয়ক পত্র-পত্রিকাও ছিল। পূর্বোল্লেখিত
'রোমাঞ্চ' ছাড়াও 'রহস্য পত্রিকা', 'গোয়েন্দা তদন্ত ' ইত্যাদি এবং
অনেক নামীদামী লেখকও সেখানে গোয়েন্দা কাহিনী লিখেছেন। কিন্তু তাঁদের
সাহিত্যিক পরিচিতি গোয়েন্দা-কাহিনীকার হিসেবে নয়, ঔপন্যাসিক বা প্রবন্ধকার
হিসেবে। তাঁদের সেই লেখাগুলো খানিকটা সখের লেখা। ফলে সেগুলির মধ্যে
ঘটনার অভিনবত্ব, প্লটের জটিলতা, ঘটনাবলীর সম্ভাব্যতা, ফরেন্সিক বিজ্ঞান
বিষয়ক জ্ঞান, অপরাধ-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিতি
ও বিভিন্ন সম্ভাবনার সূক্ষ্ম বিচার -বিশ্লেষণ অনেক সময়েই অনুপস্থিত।
এই প্রসঙ্গে প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, " একটি বহু-পঠিত
উপন্যাসে একজন গোয়েন্দা হাওড়া স্টেশন ছাড়বার এক ঘণ্টা পরে ট্রেন
থেকে পর্বতমালা ও ঝর্ণার শুভ্র রেখা দেখতে পেলেন। অন্য এক প্রাচীন
লেখকের একটি উপন্যাসে আছে একজন গোয়েন্দা 'বৃক্ষকোটরে অনুবীক্ষণ লাগাইয়া'
দূরবর্তীবাড়িতে ডাকাতির দুষ্কৃতি দেখতে পেলেন।" এগুলো অবশ্য
বহুকাল আগেকার রচনা। কিন্তু পরবর্তী কালেও বিজ্ঞানের মাথায় ডাণ্ডা
মেরে গোয়েন্দাকাহিনী তর তর করে এগিয়ে চলতে দেখা গেছে। যেমন, গোয়েন্দার
সাবমেরিনে করে পুকুরে নেমে যাওয়া, কিংবা দুই হাতে পিস্তল আরেক হাতে
টর্চ নিয়ে ঘোরা, অথবা ঘড়িতে ঢং ঢং করে একটা বাজা! কিশোর পাঠকদের
ক্ষেত্রে যা চলে বড়দের অভিজ্ঞ চোখে তা হাস্যকর হয়ে উঠতে পারে। ভালো
গোযেন্দাকাহিনী লিখতে হলে যে পরিমাণ পড়াশুনো বা পরিশ্রমের
প্রয়োজন,
নামীদামী লেখকরা তা হয়তো করতে চান না। যাঁরা করতে প্রস্তুত, তাঁরা
কুশলী লেখক নন। সেইজন্যেই বোধহয় বাংলা সাহিত্যে উঁচুদরের মৌলিক গোয়েন্দাকাহিনীর
এতো অভাব।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে
গোয়েন্দাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায়। তবে গল্পের
জটিলতা নয়, লেখার প্রসাদগুণই তার প্রধান কারণ। উনিও লিখেছেন কিশোরদের
জন্যে, যদিও বড়দের কাছেও উনি সমান ভাবে প্রিয়।
বড়দের জন্যে বাংলায় ভালো গোয়েন্দা
গল্প লেখা হয় না কেন। এই প্রশ্নে একজন লেখকের উত্তর - দোষটা অনেকটাই
বাঙালী পাঠকের। বাঙালী পাঠকরা জটিল প্লটের কোনও গল্প পড়তে আগ্রহী
নয়, তাই ইচ্ছে থাকলেও লেখকরা সেরকম গল্প ফাঁদতে পারেন না। পাঠক নেই,
তাই প্রকাশকরাও সেই বই ছাপতে রাজি হবেন না। এই অভিযোগ হয়তো আংশিক
ভাবে সত্য - কিন্তু সত্যিকারের ভালো বই স্বীকৃতি পাবে না, এটা বিশ্বাস
করাও কঠিন।
No comments:
Post a Comment